ইউরেনাস আমাদের সৌরজগতের সপ্তম গ্রহ। গ্রহটি পৃথিবী থেকে খালি চোখে দেখা গেলেও প্রথমে একে অনেকে নক্ষত্র বলে ভুল করতো, পরবর্তীতে টেলিস্কোপের সাহায্য নিয়ে এর গ্রহ হবার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। এক্ষেত্রে এটিই প্রথম গ্রহ যা টেলিস্কোপ ব্যবহার করে আবিস্কার করা হয়েছে। ইউরেনাস আবিস্কারের ফলেই অবশ্য পরবর্তী গ্রহ নেপচুনের অস্তিত্বের ব্যাপারে অনুমান করা গিয়েছিল। ইউরেনাস আবিস্কার করেছিলেন জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম হার্শেল ১৭৮১ সালে। যদিও প্রথমে তিনি একে ধূমকেতু হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।
ইউরেনাসের নামকরণ হয় ক্রোনাসের (স্যাটার্ন) বাবা বা জিউস (জুপিটার) এর দাদা’র নামে। যিনি আকাশের দেবতা এবং তাঁর রোমান নাম ওরানস। এটিই একমাত্র গ্রহ যার নামকরণ গ্রিক দেবতার নামে। তবে, আবিস্কারের প্রথম ৭০ বছর এর কোন নাম দেয়া হয়নি। শুরুতে ইংল্যান্ডের রাজা ৩য় জর্জ এর সম্মানার্থে হার্শেল এর নামকরণ করতে চেয়েছিলেন জর্জিয়ান গ্রহ, তবে ব্রিটেনের বাইরে এই বুদ্ধিটা কারো পছন্দ হয়নি। এর পরিবর্তে অনেকে হার্শেলের নামেই গ্রহটির নামকরণ করতে চান, অনেকে নেপচুন নামটির পরামর্শও দেন (তখনও নেপচুন গ্রহটি আবিষ্কৃত হয়নি)। ইউরেনাস নামটি ১৭৮২ সালে প্রস্তাব করেছিলেন জোহান বোড। তাঁর যুক্তি ছিল, নতুন এই গ্রহটির নাম যদি রোমান না হয়ে গ্রিক দেবতার নামে হয় তবে তা আগের আবিষ্কৃত গ্রহগুলো থেকে আলাদা মনে করা যাবে। তাছাড়া জুপিটারের পরের গ্রহের নামকরণ করা হয়েছিল তাঁর বাবা স্যাটার্ন এর নামে, আর এ হিসেবে এর নাম স্যাটার্নের বাবার নামে করাই যৌক্তিক। পরে ১৮৫০ সালে ইউরেনাস নামটি সর্বজনস্বীকৃত হয়।
ইউরেনাস গঠনের ইতিহাস হিসেবে ধারণা করা হয় এটি গঠনের সময় সূর্যের কাছাকাছিই ছিল, পরে কালের বিবর্তনে দূরে সরে গিয়েছে। গ্যাসীয় দানব বৃহস্পতি ও শনি গ্রহদের গঠনের সময় অধিকাংশ পদার্থ নিজেদের দিকে টেনে নেয়ায় ইউরেনাস ও নেপচুন এদের মতো এত বড় হতে পারেনি, ফলে এদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় না পেরে দূরের কক্ষপথে গিয়ে স্থিতিশীল হয়।
ভরের দিক থেকে এটি পৃথিবী থেকে সাড়ে চৌদ্দ গুণ বৃহৎ। এর ব্যাস ৫১,১১৮ কিলোমিটার, যা পৃথিবীর চার গুণ। ঘনত্বের দিক থেকে সৌরজগতের গ্রহদের মধ্যে এর স্থান এটি দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। এর কারণ এটি মূলত পানি, অ্যামোনিয়া, মিথেন ইত্যাদির বরফ দিয়ে তৈরি। এ কারণে একে বরফ দানবও বলা হয়ে থাকে। গ্যাসীয় দানব গ্রহের প্রায় ৮৫%ই গ্যাসের তৈরি, এদিকে বরফ দানবদের ক্ষেত্রে গ্যাসের তুলনায় বরফের পরিমাণ বেশি।
ইউরেনাসে দিনের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৭ ঘণ্টা, তবে এক বছর হতে পৃথিবীর ৮৪ বছর লাগে এখানে। একটি মজার ব্যাপার হচ্ছে ইউরেনাস নিজ অক্ষে অন্যান্য গ্রহের মতো কোণে ঘোরে না। এর অক্ষ ৯৭.৭৭° কোণে বেঁকে থাকায় এর মেরু সূর্যের দিকে মুখ করে ঘোরে। -২২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াল তাপমাত্রা নিয়ে ইউরেনাস সৌরজগতের সবচেয়ে শীতল গ্রহ। এর কারণ যদিও পরিষ্কার নয়। ধারণা করা হয় কোন কারণে এর কেন্দ্র থেকে উৎপন্ন তাপ এর পৃষ্ঠে আসতে পারে না। আরেকটি তত্ত্বমতে কোন এক বিশাল সংঘর্ষের ফলে ইউরেনাস এর আদি উত্তাপের অধিকাংশই হারিয়েছে, তাই এটি এত শীতল।
ইউরেনাস গ্রহটি তিন স্তর বিশিষ্ট। এর কেন্দ্রে রয়েছে সিলিকেট/লোহা-নিকেলের পাথুরে মজ্জা, পরের স্তর পানি, অ্যামোনিয়া ও মিথেনের বরফে তৈরি এবং সবচেয়ে বাইরের স্তর হাইড্রোজেন, হিলিয়াম ও মিথেনের গ্যাসীয় আচ্ছাদন। ধারণা করা হয় ইউরেনাসে তীব্র তাপমাত্রা এবং চাপের কারণে কার্বন পরমাণু হীরায় পরিণত হয় এবং পরে তা বৃষ্টি হিসেবে পতিত হয়! একই ঘটনা বৃহস্পতি, নেপচুন ও শনিতে ঘটে বলে ধারণা রয়েছে।
এর অক্ষের মতো ইউরেনাসের চৌম্বকক্ষেত্রও অদ্ভুত রকমের। প্রথমত এটি গ্রহের কেন্দ্র থেকে উৎপন্ন হয়নি, দ্বিতীয়ত এটি অক্ষের সঙ্গে ৫৯ ডিগ্রি কোণে হেলে আছে! স্থানভেদে এই ক্ষেত্রের শক্তি আলাদা আলাদা রকমের। কোথাও কোথাও এটি পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের তুলনায় ১/৩ ভাগ, আবার কোথাও ৪ গুণ বেশি শক্তিশালী হতে পারে!
এখন অবদি ইউরেনাসের ২৭টি উপগ্রহ আবিস্কার করা সম্ভব হয়েছে এবং এদের নামকরণ করা হয়েছে শেক্সপিয়ার ও আলেক্সান্ডার পোপের নানা রচনার চরিত্রদের নামে। এই উপগ্রহগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে ৫টি। মিরান্ডা, এরিয়েল, আমব্রিয়েল, টাইটানিয়া এবং ওবেরন। প্রধান হলেও এরা আকারে খুব বেশি বড় না। ৫টির ভর একত্রে যুক্ত করা হলেও এরা নেপচুনের চাঁদ ট্রাইটনের ভরের চেয়ে কম হবে।
ইউরেনাসের চারপাশেও শনির মতো একাধিক বলয় রয়েছে, যদিও তা শনির মতো এত বিশাল আকারের নয়! ধারণা করা হয় আজ থেকে প্রায় ৬০ কোটি বছর আগে কোন বড় বস্তুর সংঘর্ষের সময় এর উৎপত্তি। ১৯৭৮ সালে প্রথম ৯টি আলাদা বলয় আবিষ্কৃত হয়, এরপর ১৯৮৬ সালে আরও দুইটি বলয় এবং সর্বশেষ ২০০৩ ও ২০০৫ সালে আরও দুইটি বলয় আবিষ্কৃত হয়। শনির বলয় চকচকে হলেও ইউরেনাসের বলয় তেমন উজ্জ্বল নয়, এছাড়া এটি তেমন চওড়াও নয়। এ বলয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিস্তৃত বলয়ের নাম এপসাইলন। এর বিস্তার স্থানভেদে ২০-১০০ কিলোমিটার।
এখন অবদি এই গ্রহে কোন মহাকাশযান পাঠানো হয়নি, তবে ১৯৮৬ সালে ভয়েজার-২ এর পাশ দিয়ে যাবার সময় কিছু তথ্য জানা সম্ভব হয়। শীঘ্রই এখানে আর কোন অভিযানের পরিকল্পনা নেই।